দেশের প্রথম যোগাযোগ স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’ আজ মহাকাশে তার নিজের কক্ষপথ পরিভ্রমণ করছে। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর আকাশে প্রায় ৬,৬০০ কৃত্রিম উপগ্রহ ছাড়া হয়েছে; তার ভেতর প্রায় ৩,৬০০ উপগ্রহ এখনও আকাশে আছে। একা রাশিয়াই উড়িয়েছে প্রায় ১৫০০ উপগ্রহ। তারপর আমেরিকা ১৩০০ টি, চীন ২১৩ টি, জাপান ১৫০ টি এবং ভারত ৬৩ টি। এই পৃথিবীর বেশিরভাগ উপগ্রহই গুটি কয়েটি দেশের হাতে। কিন্তু এরা সবাই কি জীবন্ত আছে? না, তা নেই। ৩১ আগস্ট ২০১৫ সালের এক তথ্যমতে, বর্তমানে জীবন্ত আছে মাত্র ১,৩০৫ টি কৃত্রিম উপগ্রহ (তথ্যসূত্র: Union of Concerned Scientists)। বাকিগুলো তাদের জীবন কাটিয়ে আকাশেই রয়ে গেছে। কেউ তাদেরকে ফিরিয়ে আনেনি পৃথিবীর মাটিতে। আকাশের আবর্জনার সাথে মিশে গেছে তাদের ভাসমান জীবন। এই উপগ্রহগুলো আকাশপথকে করে ফেলেছে ঝুকিপূর্ণ।
জীবন্ত প্রায় ১৩০০ উপগ্রহের ভেতর নতুন করে যুক্ত হয়েছে আমাদের একটি উপগ্রহ। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, সারা বিশ্বে যখন পর্যান্ত স্যাটেলাইট রয়েছে, সেখানে আমাদের এই স্যাটেলাইটটি বিলাসিত কি না? এখানে কিছু তথ্য-উপাত্ত দেয়া যেতে পারে। বিটিআরসি`র তথ্যমতে, এই প্রজেক্টের জন্য তারা থ্যালাসকে ১৫ বছরে দেবে ২৪০ মিলিয়ন ডলার। তারপর এই উপগ্রহটিরও মৃত্যু হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বছরে ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে চলে যায় স্যাটেলাইট ভাড়া বাবদ। সেই হিসেবে ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যেতো ২১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। নিজেদের একটি উপগ্রহ পেতে আমাদের বাড়তি ব্যয় করতে হলো ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থ্যাৎ বছরে ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাড়তি খরচ হবে।
তবে বিটিআরসি`র নতুন চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ সাহেব চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে বেশ কিছু তথ্য দেন। তার মতে, এই উপগ্রহের ট্রান্সপন্ডার ভাড়া দিয়ে আয় হবে ১ বিলিয়ন ডলার; এবং ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম) পদ্ধতির কাছে স্যাটেলাইট ভাড়া দিয়ে আরো আয় হবে ১.৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে দুটি প্রতিষ্ঠানকে ডিটিএইচ লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। তারা শিঘ্রই ভারতের টাটা স্কাইয়ের মতো বাংলাদেশেও ডিস এন্টানার মাধ্যমে টিভি এবং ইন্টারনেট সেবা দিতে শুরু করবে।
তবে এটা ঠিক যে, সারা বিশ্বে স্যাটেলাইট ব্যবসা বেশ উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। স্যাটেলাইট অপারেটর ফাইনান্সিয়াল এনালাইসিসের মতে, সারা বিশ্বে ট্রান্সপন্ডার থেকে আয় কমতির দিকে। এবং স্যাটেলাইস ব্যবসায়ীরা বেশ চাপের মুখে রয়েছে। তবে পাশাপাশি নতুন নতুন চাহিদাও তৈরী হচ্ছে। যেমন উড়োজাহাজে এখন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়ছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এই সেবা দেয়া হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে মেশিন-টু-মেশিন (এম-টু-এম) এবং ইন্টারনেট-অফ-থিংকস (আই-ও-টি)। এই দুই প্রযুক্তির মাধ্যমে শিপিং, কৃষি, সরকার, মিলিটারি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক চাহিদার তৈরী হচ্ছে। পুরো বিশ্বেই এই বাজার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশ বিশ্বের ৫৭তম স্যাটেলাইট মালিক দেশ হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তির এই কাটিং-এজ সেবা নিতে পারবে কি না, তা সবসময়ই প্রশ্ন সাপেক্ষ বিষয়। তবে দেশের নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে অন্যদের কাছে তা ভাড়া দিয়ে এটা হয়তো লোকসানের প্রকল্প হবে না, তা বলা যেতে পারে।
বাংলাদেশে বড় কোনও প্রজেক্ট হলেই তাকে ঘিরে নানান ধরনের কথা চলতে থাকে। তার মূল কথা হলো, এই প্রজেক্ট থেকে কে কত টাকা বানিয়েছেন। এটা একটা ব্রিজ তৈরী করলে যেমন হয়, রেলের বগি কিনলে হয়, সিএনজি স্কুটারের লাইসেন্সে যেমন হয়, ফ্লাই-ওভার, চার লেনের হাইওয়ে থেকে শুরু করে কম্পিউটারের কেনাকাটা পর্যন্ত বিস্তৃত।
বাংলাদেশের তথ্য-প্রযুক্তি খাতের অনেক কিছুর সাথে আমরা একমত পোষন না করলেও, আমাদের নিজেদের একটি স্যাটেলাইট থাকুক, এটার সাথে বেশিরভাগ একমত। আমাদের পতাকা বহনকারী একটি উপগ্রহ আমাদের পৃথিবী নামক গ্রহটিকে দিন-রাত প্রদক্ষিন করবে – এই সুখটুকুর মূল্য আমার কাছে অনেক। এটা হয়তো টাকা দিয়ে কেনা যাবে না। তাই এই প্রজেক্ট করতে কত টাকা খরচ হয়েছে, আর কত টাকায় করা যেত – সেই হিসেবে আমরা যাচ্ছি না। আমাদের একটি উপগ্রহ হচ্ছে, আমরা সেই মোহে আবিষ্ট। ফ্যালকন-৯ রকেট ৩ দশমিক ৫ টন ওজনের বঙ্গবন্ধু-১ যোগাযোগ স্যাটেলাইটটি মহাকাশে নিয়ে গিয়েছিল। মহাকাশে নির্দিষ্ট স্লটে এটির পৌঁছাতে ৮ দিন সময় লেগেছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন