আমাদের সূর্য এত বড় যে, এর ভেতরে তের লক্ষ পৃথিবী ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে। সূর্য থেকে মাঝে মাঝে আগুনের ফুলকি ছিটকে বের হয়, যেগুলোর একেকটার আকৃতি কয়েক’শ পৃথিবীর সমান। আর সূর্য তেমন কোনো বড় নক্ষত্রও নয়। এমন সব দানবাকৃতির নক্ষত্র মহাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে, যাদের ভেতরে দশ কোটি সূর্য এঁটে যাবে। এখন পর্যন্ত জানা সবচেয়ে বড় নক্ষত্রটি পঞ্চাশ কোটি সূর্যের সমান!
সূর্য সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য:
·
সূর্য একটি গ্যাসীয় পিণ্ড। কোন কঠিন পৃষ্ট নেই।
·
৯২ % হাইড্রোজেন এবং ৭ ভাগ হিলিয়াম রয়েছে।
·
সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্তিত এবং সমগ্র সৌরজগতের মোট ভরের ৯৯ ভাগ শুধুমাত্র সূর্যের।
·
সূর্যের ৮ টি গ্রহ , ৫ টি বামন গ্রহ, কয়েক হাজার উল্কা এবং ধূমকেতু রয়েছে।
·
সূর্যের বলয় নেই।
·
সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা প্রায় দেড় কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস
·
পৃথিবী থেকে দূরত্ব 149,597,900 km
·
গড় ব্যাসার্ধ 695,508 km
·
ভর: 1,989,100,000,000,000,000,000,000,000,000 kg
·
ঘনত্ব: 1.409 g/cm3
·
অভিকর্ষ ত্বরণ: 274.0 m/s2
·
বয়স: ৪৬০ কোটি বছর
· পারিপার্শ্বিক নক্ষত্রের সাপেক্ষে গতিবেগ: 19.7 km/s
রাতের আকাশে ঝিকিমিকি করে জ্বলছে কত তারা! একটু ভালো করে দেখলে তাদের রঙের পার্থক্য চোখে পড়ে – সাদা, হলুদ, কমলা, নীল আর লালচে তারার দল রাতের অন্ধকারে যোগ করে এক ধরণের প্রাণচাঞ্চল্য। এই দূর আকাশের বাসিন্দাদের
ভালোবেসে মানুষ এপিটাফ লিখে গেছে –
“আমরা রাতের অন্ধকারকে ভয় করিনা, নক্ষত্রদের ভালোবাসি বলে। - We have loved the stars too fondly to be
fearful of the night”
প্রতিটা তারা যেন এক একটা পরিবার জমিয়ে বসেছে মহাকাশের গ্যালাক্সীরূপী শহরজুড়ে। গ্রহগুলো তাদের ছেলে-মেয়ে, উপগ্রহগুলো যেন নাতি-নাতনী। বেশিরভাগ তারাই আবার একা নয়, দুই বা তারও বেশি তারা একে অপরের চারপাশে ঘুরে চলেছে – এই যেমন জেমিনি নক্ষত্রপুঞ্জের
দুই ‘জমজ’ তারা – ক্যাস্টর আর পোলাক্স। পোলাক্স সূর্যের মতই একাকি তারা, আর ক্যাস্টর? ছয়-ছয়টা তারার এক জটিল রাজ্য! আমাদের চিরচেনা ধ্রুবতারাও পাঁচ তারার জগত। এত দূর থেকে কি আর সেটা বোঝা যায়? মনে হয় যেন একটাই তারা, অনেক উজ্জ্বল। আকাশজুড়ে এইযে এত এত তারা, এর কোনটাতেই হয়তো আমাদের জীবদ্দশায় যেতে পারবোনা। কী ভীষণ দূরে বসে চুপিসারে ডাক পাড়ছে সবচে’ কাছের তারাগুলোও! প্রক্সিমা সেন্টরি হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে কাছের তারা – সেটাও চার আলোকবর্ষের বেশি দূরে। আলোর বেগে চললেও চার বছর লেগে যাবে সেখানে পৌছতে! সেখানে আমাদের সবচেয়ে দ্রুতগামী মহাকাশযানও কোনমতে আলোর বেগের বহু হাজার ভাগের এক ভাগ গতির সঞ্চার করতে পারে।
কিন্তু সবচেয়ে কাছের তারা কি আসলেই এত দূরে? সৌরজগত থেকে হিসেব করলে সেটা ঠিক, কিন্তু পৃথিবী থেকে? রাতের আকাশে ছোট্ট ছোট্ট বিন্দুর মতো তারা দেখে আমরা দিনের বেলার বিশাল তারাটাকে যেন ঠিক খেয়াল করিনা! তারাটা সাথী হিসেবে আর কোন তারাকে বেছে নেয়নি, একা একাই ছুটে চলেছে কোন দূর অজানার পানে – ঠিক পুরোপুরি একাও যেন নয়, সাথে করে গাদাখানেক গ্রহ আর উপগ্রহকে বগলদাবা করে। সূর্যের এই পরিবারের অন্যতম এক সদস্য আমাদের এই ছোট্ট নীল গ্রহ পৃথিবী, আর তার উপরে জীবনধারণ করে চলা এই আমরা – আমি আপনি, সবাই।
ছবিঃ সূর্য আর এর গ্রহদের আকারের
তুলনা।
এইযে সূর্য আমাদের পৃথিবী থেকে এতো দূরে, তাও কিন্তু তার গনগনে উত্তাপের হলকায় মাঝে মাঝেই প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ে! তা হবেনাই বা কেন, একটা ইয়া বড় দাঁড়িপাল্লা হাতে নিন, এবার এর একপাশে একটা সূর্য রাখুন, আরেকপাশে রাখুন একটা একটা করে আস্ত পৃথিবী। এভাবে এক সূর্যের বিপরীতে তিন লক্ষ ত্রিশ হাজার পৃথিবী রাখার পরে দেখবেন পাল্লার দুইপাশ এক সমতলে আসবে। এভাবে অন্যান্য গ্রহের সাথেও সূর্যের তুলনা করতে পারেন, তবে এত কষ্ট করার আগেই বলে রাখি – সমস্ত সৌরজগতের শতকরা ৯৯.৯৬ ভাগ ভরই কিন্তু সূর্যের একার। বাকি মাত্র ০.০৪ ভাগ ভর অন্য সব গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু আর ধূমকেতুর মিলিত প্রচেষ্টা।
পৃথিবীতে আমরা সূর্যের যে আকার দেখে অভ্যস্ত, সেটা আর একরকম থাকবেনা অন্য গ্রহ থেকে দেখলে। কয়েকটা দিন মেঘলা থাকলেই আমাদের মনে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে, ইচ্ছা করে পরিষ্কার নীল আকাশ দেখতে আর সেই আকাশে সূর্যের হাসিমাখা রোদ্দুর উপভোগ করতে। আমেরিকার সিয়াটল শহরবাসীদের মধ্যে নাকি অন্যান্য শহরের তুলনায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি – কারণ? বছরজুড়ে মেঘের দৌরাত্ম্য, সূর্যের অনুপস্থিতি।
মঙ্গল গ্রহে মানুষের বসতি এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র, সেখান থেকে সূর্যকে দেখবেন বেশ কিছুটা ছোট আর কমজোর অগ্নিপিন্ড রূপে। বৃহষ্পতি, এমনকি শনি পর্যন্ত সূর্যকে সূর্য বলেই মনে হবে, যদিও অনেকটাই ছোট আর তেজহীন অবস্থায়। আরেকটু দূরে যান – ইউরেনাস, নেপচুন বা প্লুটোর কাছাকাছি, সেখান থেকে দেখবেন কোথায় আমাদের চিরচেনা সূর্য? শুধুই একটু বড়সড় একটা তারা ঝুলে আছে আকাশে - অন্যান্য তারা থেকে সামান্য বড়, এমন কিছু ভিন্ন নয়, রোদ্দুরের কথা দূরে থাক। এবারে পৃথিবী থেকে সূর্যের দিকে এগিয়ে চলুন, শুক্র গ্রহে পৌঁছেই গরমে কাহিল অবস্থা হয়ে যাবে, আর বুধ গ্রহ থেকে তো মনে হবে হাত বাড়ালেই যেন ছুঁতে পারবেন সূর্যটাকে!
ছবিঃ বিভিন্ন গ্রহ
থেকে সূর্যের
তুলনামূলক আকার।
তো কোথা থেকে এলো এই সূর্য? কী দিয়েই বা সে তৈরি? কোথা থেকে আসে তার এত তেজ? সূর্যের জন্ম আর দশটা তারার মতোই – মহাকাশে ভাসমান গ্যাস আর ধূলিকণার বিশাল মেঘ উড়ে চলছিলো মনের সুখে। এই সুখ আর বেশিদিন বুঝি সইলোনা – চাই পরিবর্তন! মহাকর্ষীয় বলের টানা-হ্যাঁচড়ায় পড়ে এই মেঘের দল দারুণ বেগে ঘুরতে শুরু করে কোন এক জায়গাকে কেন্দ্র করে। অনেকটা ধূলিঝড়ের মতোই। কিন্তু পরবর্তীতে এই রাজ্যের গ্যাস আর ধূলিকণার দল ঘূর্ণনের কেন্দ্রের দিকে জমা হতে হতে বিশাল এক গোলকের আকার ধারণ করে। মহাবিশ্বের নিয়মই হচ্ছে, এভাবে তৈরি হওয়া গ্যাসের গোলকের ভরের উপর নির্ভর করে তার ভবিষ্যত – ভর খুব বেশি হলে হাইড্রোজেন গ্যাসের পারমাণবিক ফিউশানের ফলে তৈরি হয় হিলিয়াম আর পারমাণবিক শক্তি, যার অন্যতম এক অংশ দৃশ্যমান আলো – এর কারণে আমরা সূর্যকে দেখি জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড হিসেবে, যদিও সূর্যের তেজের মূলে আগুনের কোন প্রভাব নেই, বরং রয়েছে পারমাণবিক বিক্রিয়ার প্রভাব। সূর্যের বিকিরণের আরেক অংশ হচ্ছে ইনফ্রারেড বা অবলোহিত রশ্মি – যার কারণে রোদ্দুরে বসলে গরম লাগে। এরকম আরো নানা ধরণের রশ্মি আর কণিকার বিকিরণ করে চলেছে সূর্য অবিরত। তবে এ হলো সেই ঘুরতে থাকা গ্যাসের মেঘের ৯৯.৯৬% ভরের কাহিনী। বাকি ০.০৪% এর কী হলো? এই কম ভরের গ্যাস আর ধূলিকণার মেঘ থেকে তৈরি সূর্যের এই জগত, আমাদের সৌরজগত – গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু আর ধূমকেতু। ভর কম বলে এদের মধ্যে পারমাণবিক চুল্লি চালু হয়নি কোনদিনও। গ্রহরাজ বৃহষ্পতির এখনকার যে ওজন, তার মোটামুটি ৬০ গুণ বেশি জড়ো করতে পারলেই সে হতো আমাদের সৌরজগতের দ্বিতীয় তারা। বৃহষ্পতি গ্রহদের রাজা হতে পারে, কিন্তু সে এক ব্যর্থ তারা!
সূর্য আরও বহু মিলিয়ন বছর ধরে এখনকার মতো আলো ছড়িয়ে চললেও একসময় এই বিশাল তারারও জ্বালানি ফুরিয়ে আসবে। সূর্যের এখনকার অবস্থায় বড় পরিবর্তন আসবে এর কেন্দ্রের দিকের হাইড্রোজেন জ্বালানি ফুরিয়ে আসার সময়। এমন সময় সূর্যের আলো আর আকার দুইই বাড়তে থাকবে এবং একসময় তা পৃথিবীকে পর্যন্ত গ্রাস করে নিতে পারে। সূর্য এ অবস্থায় এর বাইরের দিকের হাইড্রোজেন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে ফুলেফেঁপে এক ‘লাল দানব’ তারায় পরিণত হবে। লাল দানব অবস্থায় প্রবেশের বহু আগেই সূর্যের খরতাপ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে পৃথিবীর নদী-নালা, খাল-বিল আর সমুদ্র-হিমবাহের সব পানি বাষ্প হয়ে মহাকাশে হারিয়ে যাবে। কাজেই, সূর্যের লাল দানব অবস্থা দেখার জন্য পৃথিবীর বুকে কোন প্রাণীর পক্ষে থাকা সম্ভব হয়ে উঠবেনা। লাল দানব হওয়ার পরে সূর্য তার হিলিয়ামের ভান্ডার পোড়ানো শুরু করবে, একসময় সব জ্বালানি ফুরিয়ে আসলে এর পারমাণবিক বিক্রিয়ায় ছেদ পড়বে। ভর হারিয়ে আর আকারে ছোট হয়ে আসা সূর্য অবশিষ্ট আলো টিমটিম করে বিলিয়ে চলবে কয়েক ট্রিলিয়ন বছর ধরে – শ্বেত বামন রূপে।
ছবিঃ শিল্পীর দৃষ্টিতে
মরুসদৃশ পৃথিবীর
বুক থেকে
দেখা ফুলে
ওঠা লাল দানব সূর্যের দৃশ্য।
শেষ করা যাক সূর্যের সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে। সূর্য থেকে আলো পৃথিবীতে পৌঁছতে সময় লাগে আট মিনিট ঊনিশ সেকেন্ড। খুব একটা লম্বা সময় না এটা, আলোর বেগে যেদিন আমরা চলতে পারবো, তখন বিকেলের হাওয়া (!) খেয়ে আসার জন্য সূর্য থেকে ঘুরে আসা যাবে। তুলনা করুন সূর্যের পরে সবচেয়ে কাছের তারার দূরত্ব দিয়ে – প্রক্সিমা সেন্টরির দূরত্ব ৪.২ আলোকবর্ষ, তার মানে আলোর বেগে চললেও সেখানে যেতে লেগে যাবে চার বছরেরও বেশি! ছোটবেলায় রঙ পেন্সিল দিয়ে সূর্য আঁকার সময় আমরা হলুদ রঙ ব্যবহার করেছি, কিন্তু সূর্যের আসল রঙ সাদা। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের
কারণে রঙ এমন হলুদাভ মনে হয়, মহাকাশ থেকে যারা সূর্য দেখেছেন, তারা জানেন সূর্যের সাদা রঙের মাহাত্ম্য। সূর্যের মহাকর্ষীয় টান পৃথিবীর চেয়ে প্রায় আটাশগুণ বেশি, কাজেই, সূর্যের যদি কোন পৃষ্ঠ থাকতো, তাতে দাঁড়ালে আপনার ওজন হতো মোটামুটি একটা গাড়ির ওজনের মতো। সূর্যের মুক্তিবেগ সেকেন্ডে ৬১৭.৭ কিলোমিটার। যদি আপনি টেকনাফ থেকে বগুড়া পর্যন্ত এক সেকেন্ডে যেতে পারেন, তাহলে সেই বেগে সূর্য থেকে রওয়ানা দিয়ে পথে বাড়তি কোন জ্বালানি ছাড়াই এর আকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে সৌরজগত ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে পারবেন। পৃথিবী যেমন নিজ অক্ষের চারপাশে ঘুরে, সূর্যেরও তেমন গতি আছে ... সূর্য তার নিজের অক্ষের চারপাশে একবার ঘুরে আসতে পৃথিবীর দিনের হিসেবে মোটামুটি পঁচিশ থেকে চৌত্রিশ দিনের মতো সময় নেয়। আর পৃথিবী যেমন সূর্যের চারপাশে ঘুরছে, সূর্যও তেমনি করে আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারপাশে ঘুরে চলেছে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সীকে একবার ঘুরে আসতে সূর্য সময় নেয় ২২৫-২৫০ মিলিয়ন বছর! তারমানে, পৃথিবী আর সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একইরকম, কারণ সূর্য তার পরিবারকে নিয়ে সদলবলে ছুটে চলেছে ছায়াপথের ‘অলিগলি’ দিয়ে। সেই সাথে ছুটে চলেছি এই আমরা, আমাদের যত পরিচিত, অপরিচিত মানুষ – সবাই!
যাওয়ার বেলা বলে রাখি, আকাশের এইযে এত নক্ষত্রপুঞ্জ,
কালপুরুষ, ক্যাসিওপিয়া,
এন্ড্রমিডা, এদের আমরা সৌরজগত থেকে যেমন দেখি, অন্য কোন তারা থেকে দেখলে তাদের আর একরকম দেখা যাবেনা, কারণ হচ্ছে দেখার অবস্থানের কারণে। ক্যাসিওপিয়া
হচ্ছে আকাশে W বা M আকৃতির নক্ষত্রপুঞ্জ।
চার বছর আলোর বেগে ছুটে প্রক্সিমা সেন্টরিতে যান, দেখবেন ক্যাসিওপিয়াতে এক নতুন তারার আবির্ভাব হয়েছে। বলতে পারেন কে সেই তারা?
ছবিঃ তৃতীয় গ্রহের সমুদ্র উপকূল থেকে সূর্য
তথ্যসূত্র ও ছবিঃ
1. Sun
2. https://solarsystem.nasa.gov/planets/profile.cfm?Object=Sun
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন